গল্প- অধিকার

অধিকার
-সুদীপা ধর

 

 

আজ বাসে অন্যদিনের থেকে ভীড়টা একটু বেশি। একটু যেন বেশীই দমবন্ধ করা পরিবেশ। তাই অস্বস্তিটা রাইয়ের একটু যেন বেশিই। ভীড় বাসে মানুষজনের গুঁতোর জন্য নয়, কোনও এক চেনা মুখ দেখতে না পাওয়ার জন্য।

আলাপ হয়েছিল আজ থেকে পাঁচদিন আগে। আলাপটা ছিল ভীষণই অদ্ভুত। সেদিন বাড়িতে মায়ের সঙ্গে অহেতুক কথা কাটাকাটি হওয়াতে মাথাটা একটু গরমই ছিল। প্রসঙ্গ ছিল বিয়ে। সবে রাই তার কেরিয়ার শুরু করেছে, তাই এখুনি নতুন কোনো সম্পর্কে বাঁধার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মা তো মা’ই সে যে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে। তার কাছে থিতু হওয়া মানে বিয়েটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যাই হোক সেদিন তর্কাতর্কির ফলে মানিব্যাগটাই নিতে ভুলে গিয়েছিল।যার ফলস্বরূপ বাসের কন্ডাক্টরকে পয়সা দিতে গিয়ে পড়েছিল সে মহাবিপদে। এক অদ্ভুত পরিস্হিতিতে পড়ে মাথা আর কাজ করছিল না রাইয়ের। সে যে কি করবে তা ভাবতেও পারছিল না। কিন্তু কথায় আছে না মন যার পরিষ্কার, ভগবান হয়তো সেই মুহূর্তে কোন দূতকে পাঠিয়ে দেয় উদ্ধার করতে।

                  হঠাৎ করে গম্ভীর গলায় পাশে বসা যুবকটির গলা- ছেড়ে দিন খুঁজে পাবেন না। বাড়িতে বোধহয় ফেলে এসেছেন। এই নিন আমি না হয় দিয়ে দিচ্ছি। ‘না’ বলার কোন যৌক্তিকতা রাই খুঁজে পেল না। ঘাড় নেড়ে সম্মতিই জানালো। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার যুবকটি আরও কিছু টাকা রাইকে দিয়ে বললো- এটা রাখুন কাজে লাগবে। হাত পাতা ছাড়া এক্ষেত্রে আর কোন উপায় ছিল না। কারণ বাড়ি ফিরতে হবে যে। ধন্যবাদ কি ভাবে দেবে? ভাবতে ভাবতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পরের স্টপেজে যুবকটি নেমে গেল।

                   যাহ্.. নিজেকেই যেন ভর্ৎসনা করতে ইচ্ছা হল। এত আহাম্মক সে কবে থেকে হল। ধন্যবাদ দেওয়া তো দূরের কথা, মুখের দিকে তাকিয়েও দেখলো না যে এত বড় একটা বিপদ থেকে তাকে বাঁচালো। না দেখতে পাওয়ার একটা চিনচিনে কষ্ট বুকে নিয়ে পরের স্টপেজে রাই নেমে গেল।

                    পরের কটা দিন শুধু একবার তাকে দেখতে পাওয়ার বাসনা। শনি ও রবিবারটি তার মনোকষ্টেই কাটলো। এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল ওই গলাটির স্বরের মধ্যে। সেই আকর্ষণকে উপেক্ষা করা খুব শক্ত। সেই আকর্ষণের সুর মূর্চ্ছনা সেই দিনের সেই ক্ষণটুকুতে এতটাই বেষ্টন করে রেখেছিল যে মানুষটাকে না দেখেই তার গলার স্বরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। তার দৃঢ়চেতা বাচনভঙ্গির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।কথাতো সে বিশেষ বলেনি, অথচ কি টান ওই কটা কথার মধ্যে।

                       আজ আবার যথারীতি অফিস যাওয়ার হুড়োহুড়ি। আবার সেই চেনা ছক। আজকে যথারীতি বাসে উঠে সিট  পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চোখ যে ঘুরছিল সেই মানুষটির উদ্দেশ্যে। একবার শুধু তাকে  দেখার জন্য মনটা করছিল ছটফট। কিন্তু না আজও তাকে দেখেতে পেল না। এইভাবে দু- দু’টো মাস পার হয়ে গেল।

                     হঠাৎ করে সেদিন ভিড়  বাসে, মানুষের গুঁতোর মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠলো, ভালো আছেন ম্যাডাম। ব্যাগ আনতে ভোলেননি তো আজকে। মাথাটা  ভনভন করে ঘুরতে লাগল যেন, কোথায় আপনি? বাসের মধ্যেই রাই লজ্জার মাথা খেয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করলো।আরে, এই যে রডের পাশে। রাই বাচ্চাদের মতন চিৎকার করে বলে উঠলো, কোথায় ছিলেন এতদিন দেখতে পাইনি। রোজ খুঁজেছি আপনাকে, ধন্যবাদটুকু পর্যন্ত দিতে পারিনি।  চলন্ত বাসে এই এতো অচেনা মানুষ শুনছিল এই দুই অচেনা মানুষ দু’টির কথোপকথন। কিন্তু এদের দুজনের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এই ভাবেই আলাপটা বেড়ে গেল আস্তে আস্তে। রাই এই সম্পর্কের ভিত্তি গড়তে একটু বেশি উদ্যত হয়েছিল।  অর্ণব কোনোদিন বুঝতে পারেনি রাই তাকে এত ভালবাসে। অর্ণব একজন ভাল বন্ধু হিসাবে রাইয়ের সাথে মেলামেশা করতো। এখন আর একমাস দু’মাসের নয় মাঝে মাঝেই এখানে ওখানে দেখা হয় দুজনের ।

                        এইভাবেই রাইয়ের দিনগুলি বেশ ভালই কাটছিল। একদিন অত্যন্ত সাহস করেই প্রস্তাবটি রেখেছিল রাই…বিয়ে করবে আমায়, আমার হাতটা শক্ত করে সারা জীবনের মতো ধরবে তুমি?

                      সোজাসুজি সপাটে গালে চড় মারার মত উত্তর এলো ‘না’। পৃথিবীটা মুহূর্তে যেন রংহীন হয়ে গেল রাইয়ের কাছে। এত বড় লজ্জা, অপমানিত সে বোধহয় কোনো দিন হয়নি। ‘কেন’ জিজ্ঞেস করাতে অর্ণব যা বলেছিল তাতে রাই তাই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিল। জানো রাই আমি তোমাকে বলিনি বাসে করে কোথায় যাই। ডক্টর চেম্বারে রিপোর্ট দেখাতে, আমার যে মারণরোগ। সময় ঘনিয়ে এসেছে, বেশি দিন বাঁচবো না, ধরে নাও বড়জোর এক দু’ বছর। তাইতো ইচ্ছা করলেও তোমায় আমি বাঁধতে পারব না। ভগবান কাউকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।তাই ভালোবাসো, তুমি আমাকে এই কথাটি আর বলো না। আজকের পর থেকে আর এসো না দেখা করতে। এটাই শেষ দেখা।

                    ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল রাইয়ের। ঘোর কাটার পরমুহুূর্তে রাইয়ের উক্তি ওই দুই বছরই আমি তোমার সাথে ঘর বাঁধতে চাই। আমার ভালোলাগার মানুষটার সাথে থাকতে চাই। এটাই ভালোলাগা, এটাই ভালোবাসা। এই ভালোবাসাটুকু আমি হারাতে চাই না। এটা আমার হক, আমার ‘অধিকার’।  রাইয়ের কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল যেখানে হেরে গেল অর্ণব। বাকরুদ্ধ হয়ে গাল বেয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

                    একটি ফুলের ঝরে পড়ার কষ্ট সেই হয়তো বোঝে যে ফুলটিকে ভালোবেসেছে, সেই অর্ণব নামক ফুলটি তাই ঝরে পড়ার আগে রাই তাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চায়, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে।

Loading

One thought on “গল্প- অধিকার

Leave A Comment